স্টাফ রিপোর্টার,
জাতীয় কাউন্সিলে ত্রি-বার্ষিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ। এতে দলের ভালো-মন্দের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রিক চার উপজেলায় দলের মধ্যে দ্বন্দ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আল-মামুন সরকার স্বাক্ষরিত ১০ পৃষ্ঠার ওই সাংগঠনিক প্রতিবেদনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী না রাখার প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এছাড়া চার বছরে হওয়া দলের আয়-ব্যয়ের হিসেবও তুলে ধরা হয়েছে বিস্তারিতভাবে। বহিস্কারের সুপারিশ করা পাঁচজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে এতে।
এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেয়ার। আশা করছি দলীয় সভানেত্রী রিপোর্ট পড়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।’
সাংগঠনিক কার্যক্রমঃ- প্রতিবেদনে সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর সম্মেলনের পর ২০১৫ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় অনুমোদন লাভ করে জেলা কমিটি। পাঁচটি উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি ও চারটি উপজেলায় আহবায়ক কমিটি দিয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান কমিটির মেয়াদকালে উপদেষ্টা পরিষদের সাতটি সভা, সম্পাদক মন্ডলীর নয়টি সভা, ১২টি জরুরি সভা, কার্যনির্বাহী কমিটির ৪৭টি সভা, বর্ধিত সভা পাঁচটি, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে একটি প্রতিনিধি সম্মেলন ও বিভিন্ন দিবসে ১৮৩ টি জনসভা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে সফলভাবে নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান ও পুরাতন সদস্য নবায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয়।
দ্বন্দ্ব ও পরামর্শঃ- উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নবীনগর, সরাইল ও নাসিরনগরে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আশুগঞ্জ উপজেলা কমিটি দ্বিধা বিভক্ত বলে প্রতিবেদন বলা হয়। দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান বাদল এবং বর্তমান সংসদ সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল যৌথভাবে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করলে সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। একইভাবে নাসিরনগরে বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান সরকার ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করলে সেখানেও কোন মতবিরোধ থাকবে না। সরাইলে আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদের হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে ইকবাল আজাদের স্ত্রী শিউলী আজাদ এম.পি’র দ্বন্দ্বে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিভক্ত। এখানে দুই পক্ষের সহাবস্থান কিংবা তৃতীয় পক্ষের কাছে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব না দেয়া পর্যন্ত এখানে দ্বন্দ্ব নিরসন হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। আশুগঞ্জে আওয়ামী লীগের অবস্থান সুদৃঢ় হলেও দলটি দুইভাগে বিভক্ত। উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের বিভক্তির সৃষ্টি হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশৃংখলা সৃষ্টিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের প্রস্তাবঃ- জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে কার্যত কোনো দ্বন্দ্ব বা কোন্দল নেই বলে উল্লেখ করা হয়। তবে বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং প্রার্থীর বিরোধিতাসহ দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিতে অভিযুক্তদের নাম প্রেরণ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেয়া আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যথায় ভবিষ্যতে দলের বিশৃংখলা সৃষ্টিকারি, বিশ্বাসঘাতককারিদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না বলে প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। প্রসঙ্গত, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আমানুল হক সেন্টু, সহ-সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মো. হেলাল উদ্দিন, সাবেক সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি মোঃ কাউছার, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনারা আলমকে বহিস্কারের সুপারিশ করে ইতিধ্যেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
আর্থিক ও অন্যান্যঃ- সাংগঠনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দলের নিজস্ব কার্যালয় স্থাপনে জমি কেনার চেষ্টা চলছে। অচিরেই সুবিধাজনকস্থানে জমি কিনে তহবিল সংগ্রহ করে ২০২০ সালে ‘মুজিব বর্ষে’ দলের নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হবে।
প্রায় চার বছরের আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্যও তুলে ধরা হয় সাংগঠনিক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রথম সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জেলা আওয়ামী লীগের নামে ব্যাঙ্ক হিসেব খোলা হয়। বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে জামানত বাবদ প্রাপ্ত অর্থ, কর্মসূচি উপলক্ষে নেতৃবৃন্দ ও শুভাকাংখীদের দেয়া এককালীন অর্থ, মাসিক চাঁদা ব্যাঙ্কে জমা রেখে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জামানত থেকে প্রাপ্ত টাকার ৫০ ভাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রদান করা হয় বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ি ২০১৫ সাল থেকে ১০ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে প্রায় এক কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রায় ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে সমবায় মার্কেটে জেলা আওয়ামী লীগের নামে তিনটি দোকানের পজিশন ক্রয় করা হয়। বর্তমানে ব্যাঙ্কে প্রায় ১৬ লাখ টাকা রয়েছে। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের ‘সিনিয়র ফেলোশিপ কোর্স’ এ তহবিল সংক্রান্ত পর্যালোচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে দেশের রাজনৈতিক দলের জন্য মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তিনটি প্রস্তাবঃ- জাতীয় সম্মেলনে অনুমোদনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবেদনে তিনটি প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবগুলো হলো, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে নুন্যতম দুইটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতাকারি এবং দলের বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগে অভিযুক্তদের দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সমূহের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর মতামতের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অনেক ক্ষেত্রে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে দলের ক্ষতির কারণ ঘটে। এ কারণে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়নে বর্তমান আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়।
তৃতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনে তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়। যে কারণে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এতে স্থানীয়ভাবে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়ে দলীয় সাংগঠনিক শক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ভবিষ্যতে এসব নির্বাচনে তৃণমূলের মতামত ও সুপারিশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী বাছাই ও মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।