স্টাফ রিপোর্টার:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে মঙ্গলবার ৪৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র সদর মডেল থানাতেই ৪০টি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া আশুগঞ্জ থানায় ২টি, সরাইল থানায় ২টি ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় ১টি মামলা দায়ের করা হয়। মঙ্গলবারই সদর থানায় ৪টি মামলা দায়ের করা হয়। মোট ৪৫টি মামলায় ৩০ হাজারেরও বেশি লোককে আসামী করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ৩২ জনের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কোন নেতা-কর্মী নেই।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হরতালের দিন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুরকারী আরমান আলিফ-(২২)। গত ৪ মে রাতে সদর উপজেলার বিশ্বরোড এলাকা থেকে র্যাব-১৪ এর একটি দল গ্রেপ্তার করে। পরে র্যাব সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার কাজীপাড়ায় আরমান আলিফের ভাড়া বাসায় তল্লাশী চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙ্গার কাজে ব্যবহৃত একটি শাবল, একটি বিদেশী পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন এবং ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।
এর আগে ম্যুরাল ভাঙচুরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। গ্রেপ্তারকৃত আরমান আলিফ জেলার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের ফুলকারকান্দি গ্রামের শুক্কুর মিয়ার ছেলে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার কাজীপাড়ায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে।
পুলিশ জানায়, তান্ডবের সময় ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি দেখে হামলাকারিদের শনাক্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করে তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হেফাজত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ ও মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে যাওয়া তান্ডবে ৪৫টি মামলার মধ্যে সদর থানায় ৪০টি, আশুগঞ্জ থানায় দু’টি, সরাইল থানায় দু’টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করা হয়। ৪৫টির মধ্যে ছয়টি মামলায় ১৩৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। বাকি ৩৯টি মামলায় সবাই ‘অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারী’। কোনো কোনো মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা কওমি মাদ্রাসাছাত্র-শিক্ষক ও তাঁদের অনুসারী দুষ্কৃতিকারীদের’ কথা উল্লেখ করা হয়। তবে কোনো মামলাতেই হেফাজতের কোনো নেতা-কর্মীর নাম নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘সরকারবিরোধী’ আন্দোলনে এবারই প্রথম হিন্দুদের মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। বেছে বেছে পুড়িয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়ি।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে তান্ডবের মাত্রা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে প্রয়োজন সকলের সমন্বিত প্রয়াস। পাশাপাশি সরকারের ব্যাপক ভূমিকা রাখার কথাও বলছেন তাঁরা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবায়ক আবদুন নূর একের পর এক ঘটনার জন্য বিচারহীনতার সাংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, আগের ঘটনাগুলোর বিচার হলে একই শক্তি আবারো এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে সাহস পেতো না।
সুর স¤্রাট ওস্তাদি দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সাধারন সম্পাদক মনজুরুল আলম বলেন, ‘২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারিও এখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সে ঘটনার বিচার হয় নি। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান আমলে মৌলবাদ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও দেশ স্বাধীনের আগে এ ধরণের ঘটনা ঘটেনি। এবারের ধ্বংসযজ্ঞে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়। এসব থেকে বুঝা যায় এটা পরিকল্পিত হামলা।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, ‘৭১ এর মতো বর্বরোচিত তান্ডব চালানো হয়েছে। বেছে বেছে সরকারি অফিসের পাশাপাশি সংস্কৃতি অঙ্গনে হামলা চালানো হয়। এ হামলা পূর্ব পরিকল্পিত। এর আগেও এ ধরণের হামলা হলে বিচার পাওয়া যায় নি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তান্ডবের ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৪৫ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর মডেল থানাতেই ৪০টি মামলা দায়ের করা হয়। ৪৫টি মামলায় ৩০ হাজারেরও বেশী লোককে আসামী করা হয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত ৩২ জন গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামীদের সনাক্ত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, রেলওয়ে স্টেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, পৌর মেয়রের বাসভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, সার্কিট হাউজ, পৌরসভা কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয় ও ডাকবাংলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবন, আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, মাতৃ সদন, এসিল্যান্ডের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কালীবাড়ি, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসভবন, তার শ্বশুরের বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসভবনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করে।