ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতাকে কেন্দ্র করে অনেকটা পুরুষশূণ্য হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানারকান্দি গ্রাম। নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক পক্ষের অর্ধশত পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। নৌকা প্রতীকের নির্বাচন করায় কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমান ও তাঁর লোকজন দ্বারা প্রতিপক্ষকে গ্রামছাড়া করার অভিযোগ ওঠেছে। ফলে জমির পাকা ধান কাটার লোক না থাকায় জমিতেই ঝরে নষ্ট হচ্ছে ধান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত নবীনগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনের সংসদ সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমপির অবস্থান নিয়ে তখন একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে তিনি উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠক করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মনিরুজ্জামান মনিরকে সমর্থন জানান। কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানও বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরের পক্ষে অবস্থান নেন। থানারকান্দি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা কাউছার মোল্লা ও তার সমর্থকরা নৌকার পক্ষে অবস্থান নেন। এ নিয়ে জিল্লুর রহমান ও কাউসার মোল্লার সমর্থকদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী কাজী জহির উদ্দিন সিদ্দিক টিটুর নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরের কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনের পরদিনই থানারকান্দি গ্রামে জিল্লুর রহমান ও কাউসার মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের ঘর-বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এছাড়াও সংঘর্ষ চলাকালে কাউসার মোল্লার সমর্থকদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় নবীনগর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাত ১২শ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। মামলার পর থেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। গ্রামের উপযুক্ত মেয়েদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যত্র। এর ফলে লোকজন না থাকায় জমির পাকা থান কাটতে পারছেন না কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। ধান কাটার জন্য চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানকে এক হাজার টাকা দিয়ে কাগজে তার সাক্ষর নিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) সরজমিনে থানারকান্দি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের বেশ কয়েকটি ফসলি মাঠের ধান পেকে কাটার উপযুক্ত হয়ে গেছে আরও দুই সপ্তাহ আগেই। ধানের শীষগুলো মাটিতে নুয়ে পড়ে ধান ঝরে পড়ছে জমিতেই। পুলিশের ভয়ে বাইরের এলাকা থেকেও ধান কাটার জন শ্রমিকরা আসছে না থানারকান্দি গ্রামে। চড়া মূল্যেও কোনো শ্রমিক ধান কাটতে রাজি হচ্ছেন না। এর ফলে বড় ধরণের ক্ষতির শঙ্কায় ভুগছেন এখানকার কৃষকরা।
থানারকান্দি গ্রামের কৃষক আসাদ আলী জানান, আমার চার ছেলের মধ্যে এক ছেলেও বাড়িতে নেই। পুলিশের ভয়ে তারা বাড়িতে আসতে পারছে না। আমার কয়েক বিঘা জমির সব ধান পেকে গেছে। কিন্তু ধান কাটতে পারছি না। কিছুদিনের মধ্যে নদীতে জোয়ার আসলে সব ধান পানিতে তলিয়ে যাবে।
গ্রামের বৃদ্ধা মজলিশ বেগম জানান, চেয়ারম্যানের লোকজন আমার বাড়িতে ঢুকে আমার কোমরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এরপর আমার ঘরে ভাঙচুর করেছে। একটা মানুষও ধান কাটতে পারছে না। এক হাজার টাকা দিয়ে চেয়ারম্যানের সাক্ষর না নিলে ধান কাটতে দিবে না।
আরেক বৃদ্ধ আক্তার মিয়া বলেন, নৌকার নির্বাচন করায় জিল্লুর রহমান ও তার লোকজন আমাদের উপর হামলা চালায়। হামলার সময় আমার ঘরে রাখা ছেলের বিদেশে যাওয়ার জন্য জায়গা বিক্রির টাকাও তারা লুট করে নিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নবীনগর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু আহমেদ জানান, পুলিশ পক্ষপাতিত্ব করে কাউকে ধরছে না। যারা দাঙ্গায় লিপ্ত ছিল তদন্ত করে তাদেরকেই ধরা হচ্ছে। যারা সাধারণ মানুষ তাদের কোনো সমস্যা নেই, তারা ধান কাটতে পারেন।