Advertisement

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রসিদ্ধ খাবার ছানামুখী পেল জিআই পণ্যের স্বীকৃতি

NewsBrahmanbaria

এই আর্টিকেল টি ৩৯।

নিউজ ডেস্ক,

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রসিদ্ধ ছানামুখী ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পন্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই মিষ্টান্ন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ডিপিডিটি কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেয়। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো একটি পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার ছানামুখী। দিন দিন দেশজুড়ে বাড়ছে এর খ্যাতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে চারকোনা বিশিষ্ট এই ছানামুখীর নাম।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা, বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম ও নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখীর কদরও পুরো দেশজুড়ে।

চিনির আবরনে থাকা দুধের ছানা দিয়ে তৈরি এক ধরণের বিশেষ মিষ্টান্নে নাম ছানামুখী। বৃটিশ আমল থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রসিদ্ধ এই ছানামুখীর সুনাম দেশজুড়ে। দিন দিন দাম বাড়ার সাথে বাড়ছে এর কদরও।

ভোজন রসিকদের কাছে রয়েছে ছানামুখীর বিশেষ কদর। অতিথি আপ্যায়নে এর জুড়ি নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজন অন্য জেলায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সাথে নিয়ে যান ছানামুখী। আবার বাইরের জেলা থেকে কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়াতে আসলেও তাকেও ছানামুখী দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। বিদায় বেলায় তাকেও দিয়ে দেয়া হয় ছানামুখী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেউ বেড়াতে এসেছেন আর তিনি ছানামুখী খেয়ে দেখেননি বা বাড়িতে ফেরার সময় ছানামুখী নিয়ে যাননি, এমন ভোজন রসিকের সংখ্যা খুবই নগন্য। প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রচুর ছানামুখী যাচ্ছে অন্য জেলায়। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, এখানকার ছানামুখী যাচ্ছে বিদেশেও।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখীর ইতিহাস শত বছরের। লোকমুখে শোনা যায়, ভারতের কাশিধাম থেকে আসা মহাদেব পাঁড়ে নামে এক মিষ্টি কারিগর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি দোকানে দুধের ছানা দিয়ে ছানামুখী নামে মিষ্টি বানানো শুরু করেন।
লোকমুখে আলোচনা আছে ভারতের কাশিধামের মহাদেব পাঁড়ে তার বড় ভাই দুর্গা প্রসাদের হাত ধরে প্রায় শত বছর আগে ভারতের কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় বড় ভাইয়ের মিষ্টির দোকান কাজ শুরু করেন তিনি। দুর্গা প্রসাদের মৃত্যুর পর আশ্রয়হীন হয়ে মহাদেব পাঁড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করেন। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় চলে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে।
তৎকালীন সময়ে বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার মেড্ডায় শিবরাম মোদকের একটি মিষ্টির দোকান ছিলো। শিবরাম মোদক তার নিজের দোকানে মহাদেব পাঁড়েকে আশ্রয় দেন। মহাদেব পাঁড়ে শিবরামের দোকানে দুধের ছানা দিয়ে ছানামুখী নামে মিষ্টি বানানো শুরু করেন। এরপর থেকে ছানামুখীর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে অন্যান্য দোকানীরাও ছানামুখী তৈরী করে বিক্রি করতে থাকেন। ছানামুখী যারা চিনেন নাম শুনলেই যেন তাদের জিহবায় জল এসে যায়। ছানামুখীর স্বাদ এতটাই বেশি যে অল্প খেলেই তৃপ্তি আসে।

ছানামুখী দেখতে চারকোণা আকৃতির। ছানামুখীর উপরে দিকটায় হালকা চিনির আবরণ থাকে। আর পুরোটায় তৈরী করা হয় দুধের ছানা দিয়ে।

একেকটা ছানামুখীর ওজন হয় ১০ থেকে ১৫ গ্রাম। সেই হিসেবে কেজিতে গড়ে ৮০/৯০ পিস ছানামুখী পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ডাঃ ফরিদুল হুদা রোড, মহাদেব পট্টি ও টি.এ.রোডের কয়েকটি দোকানে তৈরী করা হয় এই ছানামুখী।
এর মধ্যে ভোলাগিরি মিষ্টান্ন ভান্ডার, আদর্শ মাতৃ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মাতৃ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মধুরাজ মিষ্টান্ন ভান্ডার, ভোলানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার, আনন্দময়ী মিষ্টান্ন ভান্ডারের ছানামুখীসহ বেশ কয়েকটি দোকানের ছানামুখী বেশ প্রসিদ্ধ।

সংশিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক কেজি ছানামুখী তৈরি করতে গাভীর ৭/৮ লিটার দুধ লাগে। প্রথমে দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে ছানায় পরিণত করা হয়। পরে পানি ঝরে পড়বে এমন টুকরিতে ছানা রাখা হয়। ওই ছানা পরিস্কার কাপড়ে বেধে ঝুলিয়ে রেখে পানি ঝড়ানো হয়। পরে শক্ত হয়ে যাওয়া ছানা ছোট ছোট করে প্রায় সমান আকৃতির কাটা হয়। এরপর পানি, চিনি ও এলাচির মিশ্রণে তৈরি করা শিরায় ছানার টুকরো ছেড়ে দিয়ে নাড়া হয়। পরে শিরা থেকে ছানা তুলে ঠান্ডা করা অর্থাৎ শুকানো হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্র্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী জিআই পন্য হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার বিষয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনকে নিশ্চিত করেছে। ডিপিডিটিতে ছানামুখী ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নম্বর-৪১। ডিপিডিটির মহাপরিচালক মোঃ মুনিম হাসান স্বাক্ষতির জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো জিআই সনদে উল্লেখ রয়েছে, ভৌগোলিক নির্দেশক (যার নমুনা এতদসঙ্গে সংযুক্ত আছে) নিবন্ধন বইয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের নামে ২৯ ও ৩০ শ্রেণিতে জিআই-৭৫ নম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি পণ্যের জন্য চলতি বছরের ৮ এপ্রিল থেকে নিবন্ধিত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক (১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত) মোঃ শাহগীর আলম প্রথমে ও পরে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান গত ২ এপ্রিল “ছানামুখী” মিষ্টান্নকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) খাবার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ডিপিডিটির রেজিষ্ট্রারের কাছে ১০ পৃষ্ঠার একটি আবেদন পাঠান। সেখানে ছানামুখী মিষ্টান্নের বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক নাম, ছানামুখীর বর্ণনা, উৎপাদনের প্রদ্ধতিসহ নানা বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন।

জানা গেছে, জেলা তথ্য বাতায়নে পুরানো ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে উল্লেখ আছে এই ছানামুখীর নাম। প্রতি কেজি ছানামুখীর দাম ৭০০ টাকা।

জেলা শহরের আদর্শ মাতৃভান্ডারে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন দুললাল চন্দ্র পাল- (৬০)। দুলাল বলেন, ৭ থেকে ৮ লিটার দুধের সাথে এক কেজি চিনি দিয়ে তৈরি হয় এক কেজি ছানামুখী। ছানামুখী তৈরির কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে গাভির দুধ জ্বাল দিতে হবে। এরপর গরম দুধ ঠান্ডা করে ছানায় পরিণত করতে হবে। অতিরিক্ত পানি ঝরে যাবে এমন একটি পরিচ্ছন্ন টুকরিতে ছানা রাখতে হবে। পরে ওই ছানাকে কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে, যাতে সব পানি ঝরে যায়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ ঝুলিয়ে রাখলে ছানা শক্ত হবে। শক্ত ছানাকে ছুরি দিয়ে ছোট ছোট টুকরায় কাটতে হবে। এরপর চুলায় একটি কড়াই বসিয়ে তাতে পানি, চিনি ও এলাচি দিয়ে ফুটিয়ে শিরা তৈরি করতে হবে। এরপর ছানার টুকরাগুলো চিনির শিরায় ছেড়ে নাড়তে হবে। সব শেষে চিনির শিরা থেকে ছানার টুকরাগুলো তুলে একটি বড় পাত্রে রাখতে হবে। ওই পাত্রকে খোলা জায়গা বা পাখার নিচে রেখে নেড়ে শুকাতে হবে। এতেই প্রস্তুত হয়ে যাবে ছানামুখী।

আদর্শ মাতৃ ভান্ডারের মালিক রাখাল মোদকের ছেলে দুলাল চন্দ্র মোদক বলেন, ছানামুখী জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মানেই জেলার জন্য সম্মানজনক সংবাদ। আমরা খুশি। তিনি বলেন, দেশের বাইরে নিয়মিত যাচ্ছে ছানামুখী।
এ ব্যাপারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহবায়ক অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, ছানামুখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য। আমরা আমাদের এই ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করি। ছানামুখী জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা খুবই খুশী। এটি জেলার জন্য একটি সম্মানজনক সংবাদ।

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, ছানামুখী জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারিভাবে ছানামুখীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্র্যান্ডিং এর আওতায় আনা হয়েছে। জেলার ব্র্যান্ডবুকেও একে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বিদেশী অতিথিসহ মন্ত্রী পর্যায়ের যারাই আসেন, ছানামুখী দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

Advertisement

Sorry, no post hare.

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com